আসামের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী জুবিন গার্গের হঠাৎ মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ তাঁর অনুরাগীরা। ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত এই শিল্পীর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি এখন আলোচনার কেন্দ্রে। মৃত্যুর মাত্র দু'মাস আগে লেখক রিতা চৌধুরীর পডকাস্টে জুবিন তাঁর শৈশব, বলিউড অভিজ্ঞতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কের মতো বেশ কিছু অজানা কথা তুলে ধরেছিলেন। ভিজে নিউজ পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া কিছু বিশেষ অংশ এখানে তুলে ধরা হলো, যা এক 'সেল্ফ-মেইড ম্যান'-এর অবিশ্বাস্য জীবনের আখ্যান। যখন পোষা বাঘ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতেন জুবিন!
জুবিন গার্গের শৈশবের একটি ঘটনা তাঁর প্রকৃতিপ্রেমের এক দারুণ ছবি তুলে ধরে। তেজপুর থেকে বদলির পর যখন তাঁর পরিবার আসামের তামুলপুরে যায়, সেখানে তাঁর বাবা একটি বড় বাড়ি পেয়েছিলেন। এই পরিবেশ জুবিনের পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তোলে।
তিনি বলেছিলেন, সেখানে তাঁর একটি পোষা বাঘ, দুটি ময়ূর, দুটি হরিণসহ নানা রকমের পশুপাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। রোজ সকালে তাদের খাবার দিয়ে তিন কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যেতেন, আর দুপুরে ফিরে এসে আবার খাবার দিতেন। শিক্ষকেরা দেরি হওয়ার জন্য শাসন করলে তিনি প্রাণীগুলোর কথা বলতেন এবং গান গাওয়ার জন্য প্রায়ই মাফও পেয়ে যেতেন।
সবচেয়ে অবিশ্বাস্য যে ঘটনাটি তিনি তুলে ধরেছিলেন, তা হলো: তিনি ওই সময়ে বাঘ কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন। বাঘটি প্রায় দুই বছর তাঁর কাছে ছিল। বদলির সময় পরিবার সেটিকে বন বিভাগের কাছে দিয়ে দেয়। মোবাইল ক্যামেরার যুগ না থাকায় কোনো ছবি না থাকলেও তাঁর বন্ধু-স্বজনেরা এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছে
বলিউডে একসময় দারুণ জনপ্রিয়তা পেলেও জুবিন গার্গ মুম্বাইয়ের জীবনকে কখনো আপন করে নিতে পারেননি। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ১২ বছর মুম্বাইতে কাজ করলেও শহরটি তাঁর কাছে 'বিরক্তিকর' লাগত।
তিনি মনে করতেন, "আমি আসামের রাজা।" তাঁর রাজ্যে তিনিই সবকিছু, যেখানে মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর মতে, মুম্বাইয়ে অনেক রাজা, আবার কেউই রাজা নন তাই সেই রাজ্য ছেড়ে তিনি থাকতে চাননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বড় বড় তারকার মৃত্যুতেও সেখানে হাজার হাজার মানুষের শোকযাত্রা হয় না, অথচ তিনি মারা গেলে আসাম শোকের সাগরে ভেসে যাবে। (তাঁর মৃত্যুর পর ঠিক সেটাই হয়েছিল।)
অন্যদিকে, নিজের কৈশোরের কথা বলতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর একটি বিশেষ সংযোগের কথা জানান। করিমগঞ্জে থাকার সময় জুবিনরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখতে পেতেন। তিনি তখন 'স্পাইডারম্যান', 'টারজান'-এর মতো সিরিয়াল এবং বাংলাদেশের সিনেমাও দেখতেন।
জুবিন গার্গ স্কুলজীবন থেকেই গান লিখে সুর করতে শুরু করেন। যদিও তিনি ম্যাট্রিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করেছিলেন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার চেয়ে গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। যুক্তরাজ্যে সংগীত নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও তা ব্যয়বহুল হওয়ায় আর পূরণ হয়নি।
তিনি স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হলেও গানের ব্যস্ততার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর মা এ নিয়ে খুব আক্ষেপ করতেন। জুবিন গায়ক হওয়ার পরও তাঁর মা মৃত্যুর আগপর্যন্ত বারবার তাঁকে বলতেন, "তুই বিএসসিটা দিস।" মা তাঁকে যতই বলতেন, গায়ক হয়ে গেছেন আর পড়াশোনা করে কী করবেন, মায়ের মন সেটা মানতে চাইত না।
জুবিন সব সময় নিজেকে 'সেল্ফ মেইড ম্যান' বলতেন এবং চাইতেন তাঁর ভেতরের সবটুকু ভালো ও সৃজনশীলতা মানুষের জন্য রেখে যেতে। সংগীতজীবনে তাঁর বড় একটি অনুপ্রেরণা ছিলেন কিংবদন্তি গায়ক ভূপেন হাজারিকা।
প্রথম অ্যালবাম করার সময় অর্থের অভাবে মা ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙার কথা বলেছিলেন। সেই সময় তিনি ভূপেন হাজারিকার স্টুডিওতে যেতেন। একদিন ভূপেন তাঁকে গান গাইতে বলেন এবং ভুল শুধরে দিয়ে আরও ভালো গাইতে উৎসাহিত করেন। পরে অ্যালবাম বের করার মতো অর্থ জোগাড় হলে ভূপেন তাঁকে 'রেকর্ডিং কর, মিক্সিং করার জন্য বোম্বে যা' বলে আশীর্বাদ করেছিলেন।
জুবিন গার্গ তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় ৩৮ হাজারের বেশি গান গেয়ে আসামের সাংস্কৃতিক অহংকার হয়ে উঠেছিলেন। তিনি রাজনীতিসচেতনও ছিলেন এবং নিজেকে 'নন-পলিটিক্যাল সোশ্যালিস্ট' হিসেবে পরিচয় দিতেন।