নব্বইয়ের দশকের সংসারঘেঁষা সিনেমা যাঁরা মিস করেন, তাঁদের জন্য ‘ইডলি কাড়াই’ ঠিকই একটা উষ্ণ জায়গা তৈরি করে। এখনকার চলচ্চিত্রে বাজেটের চাকচিক্য, অ্যাকশন আর ভিএফএক্সে সব ঢেকে যায়। ফলে অনেকেই গল্পের সাথে নিজের জীবন মিলিয়ে নিতে পারেন না। এই ছবিটা সেই জায়গাটুকু ফিরিয়ে আনে আবেগ, পরিবার আর নস্টালজিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে।

১ অক্টোবর মুক্তির পর বক্স অফিসে খুব একটা চলেনি। বাজেট ছিল প্রায় ১০০ কোটি রুপি, আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭১ কোটিতে। তবু নেটফ্লিক্সে আসার পরই আলোচনায় ফেরে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই জায়গার ট্রেন্ডিং লিস্টে উঠে এসেছে।

একনজরে

সিনেমা: ইডলি কাড়াই
পরিচালনা ও চিত্রনাট্য: ধানুশ
অভিনয়: ধানুশ, অরুণ বিজয়, সত্যরাজ, রাজকিরণ, নিত্যা মেনন, শালিনী পান্ডে, আর পার্থিবন
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
ধরন: ফ্যামিলি ড্রামা
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট

‘ইডলি কাড়াই’ মানেই ইডলি দোকান। গল্পও ঠিক সেখান থেকেই শুরু। মুরুগানের বাবা শিবানেসান গ্রামের ছোট্ট দোকান চালান, আর ছেলে চায় বড় কিছু করতে। নিজের গ্রামের সীমানা পেরিয়ে ঝকঝকে অফিসে চাকরি পায় সে। সাফল্য আসে, সাথে আসে নতুন অহং, জটিল সম্পর্ক আর বসের ছেলের বদমেজাজ। এই অবস্থার মধ্যেই মুরুগান ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে নিজের শিকড়। এক সময় প্রশ্নটা ফের দাঁড়ায় সে কি এই পালিশ করা জীবনেই থাকবে, নাকি ফিরে যাবে সেই সহজ গ্রামীণ জীবনে?

ধানুশ অভিনয়ে যেমন স্বচ্ছন্দ, পরিচালনাতেও তেমন সঠিক জায়গায় আবেগ ধরতে জানেন। মুরুগানের চরিত্রে তাঁর স্বাভাবিক আকর্ষণ, সংবেদনশীলতা আর হাস্যরস একসাথে মিশে গেছে। নিত্যা মেনন চোখে পড়ে সংলাপ, আবেগ, রসায়ন সব মিলিয়ে তাঁর উপস্থিতি ছবির গতি বাড়িয়েছে। অরুণ বিজয় অশ্বিনের বেপরোয়া চরিত্র ঠিকঠাক তুলে ধরেছেন; কখনো অতিরিক্ত মনে হলেও তিনি গল্পে প্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দেন। রাজকিরণকে এক ধরনের নীরব পথপ্রদর্শক মনে হয়। আর পার্থিবনের ছোট দৃশ্যগুলোও হাসায়।

মীরা চরিত্রে শালিনী পান্ডে তুলনামূলক কম প্রভাব ফেলেছেন। তাঁর সাথে মুরুগানের সম্পর্কটা আরেকটু বিস্তৃত হলে ভালো লাগত। সত্যরাজ আর সামুথিরাকানিও নিজেদের ভূমিকায় স্থির।

ধানুশ টাইটেল ক্রেডিটেই বলেছেন গল্প তাঁর শৈশবের জায়গা থেকে নেওয়া। শুরুতে গল্পটা একটু চেনা লাগে, যেন আগেই বুঝে নেওয়া যায় কোন দিকে যাবে। কিন্তু লেখনী আর আবেগের শক্তি পুরোনো কাঠামোকে নতুন করে রাঙিয়ে তোলে। পারিবারিক বন্ধন, সংস্কৃতি, সমাজ সব কিছু মিলিয়ে তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন। কখনো হাসাবে, কখনো চুপচাপ বসে ভাবাবে।

একটা নৈতিক প্রশ্নও ওঠে, সফলতার পথে হাঁটতে গিয়ে যদি বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে যেতে হয়, সেটা কি ভুল? এই জায়গাটাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। কারণ বাস্তব জীবনে অনেকেই জীবিকার টানে দূরে যায়। ছবিটি সেই বাস্তবতাকে সামান্য রক্ষণশীল দৃষ্টিতে দেখেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।

কারিগরি দিকও মসৃণ। জি ভি প্রকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সংযত এবং গল্পের সাথে মানানসই। কিরণ কৌশিকের ক্যামেরা আর প্রসন্ন জির সম্পাদনা গ্রামীন আবহের উষ্ণতা ফুটিয়ে তুলেছে।

সবশেষে বলতেই হয়, ‘ইডলি কাড়াই’ গল্পে সহজ, কিন্তু অনুভূতিতে গভীর। নিজের শিকড়, পরিবার আর সম্পর্কগুলো নিয়ে একবার হলেও ভাবতে বাধ্য করবে। দেখার পরও কিছু দৃশ্য মাথায় থেকে যায় ঠিক যেমন ভোরের সেই দৃশ্য, যেখানে মুরুগান চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে থাকে আর কায়াল ঘরে ঢুকে যায়। কোনো সঙ্গীত নেই, শুধু নীরবতা, তবু মুহূর্তটা আপনাকে ধরে রাখে।

এই ছবিটা আপনাকে হয়তো ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই পুরোনো, উষ্ণ, সরল দিনের কাছে। আর নিজেকেও জিজ্ঞেস করতে বাধ্য করবে আমরা আসলে কোনটার পেছনে ছুটছি?