শোলে (Sholay) সিনেমাটি শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক যা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি মুক্তির ৫০ বছর পরেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং জনপ্রিয়। এই সিনেমাটি কীভাবে সেই সময়কার বলিউডি ছাঁচ ভেঙে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
নিখুঁত নয়, মানবিক নায়ক
শোলে-এর আগে বলিউডি সিনেমায় নায়কদের সাধারণত ত্রুটিহীন, আদর্শ এবং নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হতো। কিন্তু জয় (অমিতাভ বচ্চন) এবং বীরু (ধর্মেন্দ্র)-এর চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা ছিল বাস্তব জীবনের মতো ভালো-মন্দের মিশেলে তৈরি। তারা পেশাদার চোর এবং প্রাক্তন কয়েদি হলেও, শেষ পর্যন্ত রামগড়ের জনগণের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রাখে। এটি ছিল বলিউডে মানবিক এবং ত্রুটিপূর্ণ নায়কের এক নতুন ধারা, যা পরবর্তীকালে বহু ছবিতে অনুসৃত হয়েছে।
বন্ধুত্ব প্রেমের মতো নয়, বাস্তবের মতো
শোলের বন্ধুত্ব ছিল রোমান্টিক বন্ধুত্বের চিরাচরিত ধারণার বাইরে। জয় ও বীরুর বন্ধুত্বে ছিল ঠাট্টা, খুনসুটি, এবং মাঝে মাঝে ঝগড়াও, যা বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বের প্রতিফলন। কিন্তু প্রয়োজনে তারা একে অপরের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। তাদের এই বাস্তবধর্মী বন্ধুত্ব পর্দায় বন্ধুত্বের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে, যা দর্শক আজও মনে রেখেছে।
বাসন্তী স্বাধীনচেতা কর্মজীবী নারী
হেমা মালিনী অভিনীত বাসন্তী চরিত্রটি তৎকালীন হিন্দি সিনেমার লাজুক, পুরুষনির্ভর নায়িকাদের ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিল। বাসন্তী ছিল একজন টঙাওয়ালি, যে নিজের জীবন ও সিদ্ধান্ত নিজেই নিত। সে কেবল নারী স্বাধীনতার প্রতীকই ছিল না, বরং বলিউডে কর্মজীবী নারীর চরিত্রায়ণে পথপ্রদর্শক হিসেবেও কাজ করেছিল।
বিধবা জীবনের প্রগতিশীল উপস্থাপন
শোলেতে শুধুমাত্র অ্যাকশন ও প্রতিশোধের গল্পই ছিল না, এর পাশাপাশি ছিল এক প্রগতিশীল প্রেম কাহিনি। বিধবা রাধা (জয়া বচ্চন)-এর জীবনে প্রেমের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে ঠাকুর (সঞ্জীব কুমার) সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যখন রাধার বাবা সমাজের ভয়ে তার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন, তখন ঠাকুরের উত্তর ছিল, "সমাজ মানুষের একাকিত্ব দূর করার জন্য, তাকে একা ফেলে রাখার জন্য নয়।" এই সংলাপ তৎকালীন সমাজের জন্য এক সাহসী বার্তা ছিল।
মুক্তি পরবর্তী সাফল্য ও অজানা গল্প
প্রথমদিকে সমালোচকেরা শোলে-কে তেমনভাবে গ্রহণ করেননি। এমনকি ইন্ডিয়া টুডে সিনেমাটিকে 'নিভে যাওয়া কয়লা' বলে অভিহিত করেছিল। প্রথম সপ্তাহে বক্স অফিসেও সিনেমাটি সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দর্শক আবারো হলে ফিরে আসতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছায়।
কিছু আকর্ষণীয় তথ্য:
গব্বরের পারিশ্রমিক: আমজাদ খান অভিনীত গব্বর সিং চরিত্রটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ছবির সংলাপের জন্য আলাদাভাবে অডিও ক্যাসেট প্রকাশ করতে হয়েছিল। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমজাদ খান ৭৫ হাজার রুপি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন।
ধর্মেন্দ্রর পারিশ্রমিক: অভিনেতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ধর্মেন্দ্র। তিনি পেয়েছিলেন ১.৫ লাখ রুপি।
শেষাংশ পরিবর্তন: প্রথমে ছবির শেষাংশে ঠাকুর গব্বরকে হত্যা করত। কিন্তু সেন্সর বোর্ডের আপত্তিতে শেষাংশ পরিবর্তন করে দেখানো হয়, গব্বর ধরা পড়েছে এবং তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
অ্যাংরি ইয়াং ম্যান: শোলের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সেলিম-জাভেদ জুটি, যারা বলিউডে 'অ্যাংরি ইয়াং ম্যান' ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন।
শোলে সিনেমাটি এখনো মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি বিনোদনমূলক ছবি নয়, বরং এর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বীজ বপন করা হয়েছিল, যা আজও প্রাসঙ্গিক।