কাঠমিস্ত্রি থেকে দেশের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর: রিপন মিয়ার অনুপ্রেরণার গল্প
কৈশোরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন রিপন মিয়া। কিন্তু সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি; প্রেমিকা তাঁকে ছেড়ে চলে যান। জীবনের প্রথম ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েননি তিনি। বরং নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণা খুঁজে নেন। তখনই শুরু করেন ভিডিও বানানো। আর সেই ভিডিওই বদলে দেয় তাঁর পুরো জীবন। নেত্রকোনা সদর উপজেলার এই কাঠমিস্ত্রি আজ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর।
শুরুটা ছ্যাঁকা খাওয়া থেকে
রিপন মিয়ার জীবনে টার্নিং পয়েন্ট আসে ২০১৬ সালে। সেই সময় তিনি একটি ভিডিও বানান ‘বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিয়ো ডাক, তোমার সাথে গল্প করব আমি সারা রাত’। এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ধীরে ধীরে ফেসবুকে তাঁর ভিডিও জনপ্রিয় হতে থাকে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে রিপন বলেন,
“ছ্যাঁকা খেয়ে অনেকেই তো অনেক কিছু করে অনেকে মরে যায়, অনেকে নেশাপানি করে। আমি চিন্তা করলাম ভিডিও বানাই। যে চলে গেছে, চলে যাক। কষ্টের সময়টা ভুলতেই অনলাইনে আসা।”
শুরুতে ভিউ আর অনুসারী ছিল কম। কিন্তু সেটি নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন না। নিজের বানানো ভিডিও নিজেই দেখে আনন্দ পেতেন। তাঁর ভাষায়, “ভিডিও করতে ভালা লাগত, ভিডিও করতাম। কে দেখল না দেখল, এইতা নিয়া ভাবতাম না।” সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা বাড়তে থাকে, আর রিপন হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় মুখ।
“হা হা হা এটাই বাস্তব”
রিপনের সবচেয়ে জনপ্রিয় লাইন হলো “হা হা হা এটাই বাস্তব, আই লাভ ইউ।” এই সংলাপ শুনলেই সবার মনে আসে তাঁর নাম। বর্তমানে ফেসবুকে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ১৭ লাখ ছাড়িয়েছে। বয়স কিংবা পেশাভেদে অনেক ক্রিয়েটরের কনটেন্ট সীমাবদ্ধ থাকলেও রিপনের ভিডিও উপভোগ করেন সব বয়সের মানুষ। তাঁর কমেন্ট বক্স ভরা থাকে শুভেচ্ছা আর ইতিবাচক বার্তায়।
দিনযাপনের সরল গল্প
রিপনের ভিডিওতে উঠে আসে তাঁর গ্রামীণ জীবনধারা। ভোরে উঠে ছাই দিয়ে দাঁত মাজেন, পুকুরে গোসল করেন, তারপর চলে যান কাঠমিস্ত্রির কাজে। কাজ শেষে কখনো তাঁকে দেখা যায় খাল-বিলে মাছ ধরতে, কখনো গাছে চড়ে ফল পাড়তে। প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর মুখে থাকে অমলিন হাসি। রিপনের ভাষায়, “সবকিছুই ওয়াও লাগে।”
তিনি মনে করেন, গ্রামের আলো-বাতাসই তাঁকে সরল রেখেছে। শহরের ব্যস্ততা তাঁর ভালো লাগে না। “শহরে গেলে থাকতে পারি না। দম বন্ধ লাগে। গ্রামে যে মায়া-মহব্বত, এটা শহরে নেই।”
জনপ্রিয়তার সঙ্গে বিনয়
অনলাইনে সফলতা এবং আর্থিক সচ্ছলতা এলেও রিপন তাঁর মূল পেশা কাঠমিস্ত্রি ছাড়েননি। বরং এই কাজেই তিনি শান্তি খুঁজে পান। রিপনের ভাষায়, “অনলাইন আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু মানুষের ভাঙা ঘর ঠিক করে দেওয়া, নতুন ঘর বানিয়ে দেওয়া এই কাজ আমাকে অনেক শান্তি দেয়।”
নিজেকে সুখী মানুষ বলে মনে করেন রিপন মিয়া। বলেন, “পকেটে ২০০ টেহা, নিজের প্রতি বিশ্বাস আর বুকভরা নিশ্বাস, আমি রিপন যেখানে মন চায় চলে যাই। আমি সুখী মানুষ। বাপ-মা আর তিন ভাই মিলে একসাথে খাইদাই। জীবনে আর কী লাগে!”
আয়ের ব্যবহার ও মানবিক উদ্যোগ
অনেকে প্রশ্ন করেন, অনলাইন থেকে রিপনের আয়ের টাকা কোথায় যায়? এ প্রসঙ্গে রিপনের টিমমেম্বার সজীব জানান, তাঁর আয়ের টাকায় কয়েকটি ব্যবসা চলছে। ইতিমধ্যে “রিপনের দোকান” নামে একটি অনলাইন শপ শুরু হয়েছে, যেখানে আখের চিনি, ঘি ইত্যাদি পাওয়া যায়। শিগগিরই তিনি কাপড়ের ব্র্যান্ডও চালু করবেন।
রিপন গোপনে মানবিক সহায়তাও করে থাকেন। গ্রামে একটি লাইব্রেরি তৈরি করছেন তিনি, যেখানে একজন শিক্ষক বিনা মূল্যে পাঠদান করবেন। পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি চান, কোনো শিশু যেন দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার সুযোগ হারিয়ে না ফেলে।
সাফল্যের রহস্য: সারল্য
রিপনের সাফল্যের আসল রহস্য হলো তাঁর নির্ভেজাল সারল্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে তাঁকে মানুষ দেখে, বাস্তবেও তিনি ঠিক তেমনই। তাঁর টিমমেম্বার সজীবের ভাষায়, “রিপনের সবচেয়ে বড় গুণ হলো সরলতার সঙ্গে সততা। এত জনপ্রিয় হওয়ার পরও নিজের পেশার প্রতি তাঁর ভালোবাসা আমাদের অবাক করে।”
রিপনও মনে করেন, সবই সৃষ্টিকর্তার দান। “সব আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি যারে দেন, ছাপ্পর মাইরা দেন।”
সংক্ষেপে, প্রেমে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে আজকের শীর্ষ কনটেন্ট ক্রিয়েটর হওয়া রিপন মিয়ার গল্প আসলে অধ্যবসায়, সারল্য আর ইতিবাচক মনোভাবের গল্প। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, জীবনের দুঃখকষ্টকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়, যদি মন থেকে চাই।