ব্যবসা করার স্বপ্ন অনেকেরই থাকে, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের পথে পদে পদে যে বাধা আসে, তা মোকাবিলা করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এমনই এক স্বপ্ন আর সংগ্রামের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে অ্যামাজন প্রাইমের নতুন সিরিজ ‘ডু ইউ ওয়ানা পার্টনার’। গত ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়া এই সিরিজে দুই বন্ধু শিখা রায় চৌধুরী (তামান্না ভাটিয়া) আর অনাহিতা মাকুজিনা (ডায়ানা পেন্টি)-এর স্টার্টআপের পথচলা তুলে ধরা হয়েছে।
গল্পের প্রেক্ষাপট
ভালো চাকরি করা দুই বন্ধুর জীবন হঠাৎ মোড় নেয় যখন শিখার কোম্পানি কিনে নেন তার বাবার পুরোনো শত্রু বিক্রম ওয়ালিয়া (নীরজ কবি)। বিক্রমের হাতে চাকরি হারানোর পাশাপাশি শিখার মনে জন্ম নেয় প্রতিশোধের আগুন। অতীতে বিক্রম শিখার বাবা সঞ্জয় রায়কে (যিনি ছিলেন একজন ব্রিউমাস্টার) প্রতারণা করে তার তৈরি বিয়ার ব্র্যান্ডের মালিক হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, বড় একটি চুক্তিতে সফল হওয়ার পরও অনাহিতা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়। তার কোম্পানি বরং মনে করে, সুন্দর চেহারার কারণেই সে সাফল্য পেয়েছে। এই প্রতারণা মেনে নিতে না পেরে সে-ও চাকরি ছেড়ে দেয়।
শিখার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য এই দুই বন্ধু এবার শুরু করে ক্রাফট বিয়ারের ব্যবসা। কিন্তু তাদের এই নতুন যাত্রায় পদে পদে বাধা আসে বিয়ার তৈরি, তহবিল জোগাড়, কারখানা ভাড়া, নেটওয়ার্কিং এবং রাজনীতি। একের পর এক বিপদ তাদের সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। শেষ পর্যন্ত শিখা আর অনাহিতা কি তাদের ব্যবসা দাঁড় করাতে পারে, নাকি শুরুতেই হার মানে এমন গল্পই তুলে ধরেছে এই কমেডি-ড্রামা ঘরানার সিরিজটি।
সিরিজটির বিশ্লেষণ
‘ডু ইউ ওয়ানা পার্টনার’ একটি প্রাণবন্ত সিরিজ, যা দর্শকদের স্টার্টআপের যাত্রা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের বাধা এবং ব্যবসার অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে ধারণা দেয়। সিরিজটি দেখায় যে স্টার্টআপ মানেই এক অগ্নিপরীক্ষা, যেখানে প্রথমদিকে কেউ বিনিয়োগ করতে ভরসা করে না এবং ব্যবসা একটু দাঁড়ানো শুরু করলেই একের পর এক বাধা আসে। নির্মাতারা এখানে ক্রাফট বিয়ারের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ কিছুটা হলেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
এই সিরিজে ভারতের নয়াদিল্লির গুড়গাঁও শহরের স্টার্টআপ সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে। সিরিজের প্রতিটি পর্বের নামও স্টার্টআপ সংস্কৃতির আদলে দেওয়া হয়েছে যেমন: বুটস্ট্র্যাপ, ইউএসপি, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, দ্য লঞ্চ ইত্যাদি।
সিরিজের গল্পটি পুরোপুরি নিখুঁত না হলেও শক্তিশালী অভিনয় এটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে। কমেডির মোড়কে তৈরি এই সিরিজে কর্মক্ষেত্রে ও ব্যবসা করতে গিয়ে নারীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তামান্না ভাটিয়া ও ডায়ানা পেন্টির রসায়ন দেখতে দারুণ লাগে, তারা প্রকৃত বন্ধুর মতো একে অন্যের হাত ধরে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সিরিজটি কলকাতা এবং গুরগাঁওয়ের পরিবেশের মধ্যে আসা-যাওয়া করলেও তা বুঝতে অসুবিধা হয় না; বরং দুটি শহরের সংস্কৃতি ও যাপনের অনেক দিক উঠে এসেছে।
অভিনয় ও চরিত্রায়ণ
তামান্না ভাটিয়া এই সিরিজে খোলনলচে বদলে ভিন্ন রূপে হাজির হয়েছেন। জেদ, আত্মবিশ্বাস, প্রতিশোধ এবং ছোটবেলার ট্রমাকে তিনি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ডায়ানা পেন্টির দৃঢ়চেতা অনাহিতা চরিত্রটি বেশ সতেজ। তিনি একদিকে যেমন কর্পোরেট পরিচয় সামলেছেন, তেমনই বন্ধু, বোন, প্রেমিকা হিসেবে তাঁর চরিত্রের সংবেদনশীল দিকগুলো ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তবে প্রধান খলনায়ক বিক্রম ওয়ালিয়ার চরিত্রে নীরজ কবির অভিনয় মাঝেমধ্যে অতিনাটকীয় লেগেছে এবং তার চরিত্রটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে সেভাবে উপস্থাপন করা হয়নি, যা কিছুটা ক্লিশে মনে হতে পারে। নকুল মেহতা ববির চরিত্রে ভালো করলেও তার চরিত্রটি বিকাশের তেমন সুযোগ পায়নি। ডিলানের চরিত্রে জাভেদ জেফরি দারুণ, যদিও তার চরিত্রটি গল্পের জন্য অপরিহার্য ছিল না। ফেরদৌসের চরিত্রে সুফি মোতিওয়ালা এবং ডায়ানার সঙ্গে তার খুনসুটি দেখতে ভালো লাগে।
তবে এই সিরিজে নিজের উপস্থিতি দিয়ে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন শ্বেতা তিওয়ারি। লাইলা সিংয়ের মতো গ্যাংস্টারের চরিত্র তিনি যেভাবে ঠান্ডা মাথায় ফুটিয়ে তুলেছেন, তা ছিল দুর্দান্ত। সিরিজটিতে নারীর সংগ্রাম প্রাধান্য পেলেও এখানে পুরুষেরা ছিলেন সহযোদ্ধা, যা খুব সুন্দরভাবে প্রতিটি পর্বে তুলে ধরা হয়েছে।
দুর্বলতা ও সামগ্রিক মূল্যায়ন
সিরিজটির কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে। স্টার্টআপ জার্নিটা আরও ভালোভাবে উপস্থাপন করা যেত। বেশ কিছু দৃশ্যের পেছনের কার্যকারণ স্পষ্টভাবে দেখানো হয়নি, যেমন শিখা কেন হঠাৎ লাইলা সিংয়ের প্রস্তাবে রাজি হলো বা বন্ধুর বিপক্ষে চলে গেল, তা স্পষ্ট নয়। গল্পের ধারায় নতুনত্ব থাকলেও সিরিজটি তার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। গল্প কোথাও গতি হারিয়েছে আবার কিছু সাব-প্লট পূর্ণতা পায়নি।
তবে সব মিলিয়ে, ‘ডু ইউ ওয়ানা পার্টনার’ একটি উপভোগ্য সিরিজ। আট পর্বের এই কমেডি-ড্রামা সিরিজটি দেখতে বসলে দর্শকদের পক্ষে শেষ না করে ওঠা মুশকিল।