আলোকিত মুখ নয়, বাস্তব চরিত্রেই বিশ্বাস তাঁর: অভিনয়ের শুরুতেই নজর কাড়লেন বৃষ্টি

বিনোদন প্রতিবেদক
আসমা উল হুসনা, যিনি 'বৃষ্টি' নামে পরিচিত, বাংলাদেশি বিনোদন জগতে যুক্ত হয়েছেন নতুন এক চেনা ভঙ্গির বাইরে দাঁড়িয়ে। মডেলিং দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তাঁর ভেতরে জেগে ছিল নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। ক্যামেরার সামনে নয়, বরং পেছনে দাঁড়িয়ে গল্প বলা ছিল তাঁর ইচ্ছা। তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ওয়েব সিরিজ ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’–তে অভিনয় করার সুযোগ তাঁর পথচলার গতিপথ বদলে দেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে পড়াশোনা করা বৃষ্টি থিয়েটার চর্চার মধ্য দিয়ে শিল্পচর্চায় যুক্ত হন। অভিনয়ের চেয়ে নির্মাণেই আগ্রহ বেশি ছিল তাঁর। তবে হঠাৎ করেই ওয়েব সিরিজে কাজ করার প্রস্তাব পাওয়ার পর নিজেকে প্রস্তুত করেন পর্দার জন্য।

সিরিজে তাঁর চরিত্র ছিল ‘প্রথম’ নামের এক সাঁওতালি তরুণী। চরিত্রটি উপস্থাপন করতে গিয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে প্রবেশ করতে হয়েছে। প্রমিত বাংলা নয়, বরং সাঁওতালি ভাষার স্বরলিপি, উচ্চারণ, চালচলন ও জীবনযাপনকে ধারণ করতে হয়েছে পুরোপুরি। থিয়েটারের পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগলেও এই চরিত্র ছিল ভাষাগত ও মানসিকভাবে একটি আলাদা স্তরের চ্যালেঞ্জ।

সিরিজটির শুটিং হয়েছে দিনাজপুর এবং সুন্দরবনের মতো কঠিন লোকেশনে। জীবনের প্রথম বড় আউটডোর শুটিংয়ে অংশ নিয়ে বৃষ্টি সরাসরি মুখোমুখি হন প্রকৃতির রূঢ় বাস্তবতার। বনাঞ্চলে কাদামাটি, জোয়ারের পানি, পিচ্ছিল শ্বাসমূল—সবকিছুর মধ্য দিয়ে চলা ছিল তাঁর প্রতিদিনের অংশ। প্রতিটি দৃশ্য ধারণের পেছনে ছিল পরিশ্রম ও আত্মনিবেদনের গল্প।

শুটিং সেটে তিনি ছিলেন পুরো ইউনিটের একটি নতুন মুখ। তবে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, সময় মেনে প্রস্তুতি নেওয়া এবং ক্যামেরার সামনে চরিত্রে ডুবে যাওয়া—এসবকিছু তাঁকে একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেত্রীর অভিজ্ঞতা দেয় প্রথম কাজেই।

বাংলাদেশি বিনোদন অঙ্গনে এখনো প্রথাগত সৌন্দর্যবোধে শিল্পীদের বিচার করা হয়। গায়ের রঙ, মুখের গড়ন, চুল, উচ্চতা—সবকিছুর ভিত্তিতে একটি শিল্পীর গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হয় অনেক সময়। বৃষ্টির ক্ষেত্রেও সেই বাধা ছিল স্পষ্ট। তথাকথিত নায়িকার ছাঁচে না ফেলা গেলেও তিনি কাজ করেছেন এমন এক চরিত্রে, যেটি সাহসিকতা ও বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে।

এখনো দেশের অনেক দর্শক চেহারাভিত্তিক বিচার পছন্দ করে। নারীদের ক্ষেত্রে এই মানসিকতা আরও বেশি স্পষ্ট। যেখানে পুরুষ শিল্পীরা তথাকথিত সৌন্দর্যের বাইরে গিয়েও গ্রহণযোগ্যতা পান, সেখানে নারীদের সেই সুযোগ সীমিত। ফলে বাস্তব চরিত্রে অভিনয় করেও অনেক সময় মেয়েদের পারফরম্যান্সকে অবজ্ঞা করা হয় শুধুমাত্র তাদের চেহারার জন্য।

অভিনয় শুরু হলেও বৃষ্টির মূল আকাঙ্ক্ষা সিনেমা নির্মাণ। তাঁর বিশ্বাস, একটি গল্প যদি বাস্তব হয়, হৃদয়ে বাজে, তাহলে বিশাল বাজেট না থাকলেও ভালো সিনেমা নির্মাণ সম্ভব। বিশেষ করে নারীকেন্দ্রিক গল্প নারীর চোখে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেন গভীরভাবে।

বাংলাদেশের মূলধারার সিনেমায় নারীর গল্প অনেক সময় পুরুষ নির্মাতার দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে আসে। অথচ নারীর অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম, অবদমন—এসব সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারে একজন নারী নির্মাতা নিজেই। এই জায়গা থেকেই তাঁর নির্মাণ ভাবনা জন্ম নিয়েছে।

নতুন একজন হিসেবে প্রথম কাজেই কঠিন ভাষা, অচেনা চরিত্র, কঠোর শুটিং লোকেশন—সবকিছু মিলে এক জটিল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন বৃষ্টি। এই ঝুঁকিপূর্ণ সূচনাকেই তিনি দেখেছেন শেখার একটি সুযোগ হিসেবে। তাঁর বিশ্বাস, একজন শিল্পী হিসেবে ঝুঁকি নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে পরিপক্বতার ভিত্তি।

বাংলাদেশি বিনোদনের একটি বড় সংকট হচ্ছে একঘেয়ে চরিত্র ও গল্প। সেই গৎ ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন বৃষ্টি। তাঁর অভিনয়ের ধরন, চেহারার ভিন্নতা, চরিত্র বাছাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্মাণ পরিকল্পনা—সবকিছুতেই সেই আলাদা ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে।

পর্দায় সময় খুব বেশি না হলেও চরিত্র দিয়ে আলাদা করে চেনা গেছে তাঁকে। তিনি নায়িকা নন, চরিত্রের ভিতরে ডুবে থাকা একজন শিল্পী। তাঁর উপস্থিতি প্রথাগত ধারার বাইরে। সেই ভিন্নতা থেকেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছেন তিনি—নির্মাতা হয়ে নারীর জীবনকে নারীর চোখে তুলে ধরার প্রত্যয়ে।