নিজের থেকে ৩৭ বছরের বড় সুপারস্টারের মা! কেরিয়ার শেষ বলেছিলেন নিন্দুকেরা, ‘পা’ ছবির সাফল্যে ভুল প্রমাণ করলেন বিদ্যা বালান

২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পা’ ছবির কথা মনে আছে? অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়, চরিত্রের অদ্ভুত রূপ, আর একেবারে অন্যধারার গল্প—সব মিলিয়ে সিনেমাটি বলিউডের ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো অধ্যায়। তবে এই সিনেমার আরেকটি ব্যতিক্রমী বিষয় ছিল অভিনেত্রী বিদ্যা বালানের সিদ্ধান্ত—নিজের থেকে ৩৭ বছরের বড় সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা! বলিউডে যেখানে অভিনেত্রীরা বয়সের ছাপ পড়ার আগেই কাজ হারানোর ভয় পান, সেখানে এক উঠতি অভিনেত্রীর এই সিদ্ধান্তে তখন গোটা ইন্ডাস্ট্রি চমকে গিয়েছিল।

বিদ্যা বালান—ছোটপর্দা থেকে বড়পর্দায়ঃ
বিদ্যা বালানের অভিনয় যাত্রা শুরু টেলিভিশন থেকে। ‘হাম পাঁচ’ ধারাবাহিক দিয়ে জনপ্রিয়তা পেলেও বলিউডে নিজের জায়গা করে নিতে সময় লেগেছে অনেকটা। তবে বিদ্যার প্রতিভা ও দৃঢ়চেতা মনোভাব তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বলিউডে ‘পরিণীতা’ দিয়ে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করে প্রশংসিত হন। এরপর একের পর এক ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বিদ্যা নিজের আলাদা পরিচিতি গড়ে তোলেন।

‘পা’ ছবিতে অদ্ভুত কিন্তু চ্যালেঞ্জিং চরিত্রঃ
২০০৯ সালে পরিচালক আর. বালকি তাঁর নতুন সিনেমা ‘পা’-র চিত্রনাট্য নিয়ে হাজির হন বিদ্যার কাছে। সেখানে তিনি জানান, ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের চরিত্র হবে একটি ১২ বছরের ছেলের, যিনি বিরল প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। এই ছেলের মা হিসেবে তিনি বিদ্যাকে ভাবছেন, আর বাবার চরিত্রে থাকবেন অভিষেক বচ্চন। অর্থাৎ, বাস্তবে যেখানে অমিতাভ অভিষেকের বাবা, সেখানে সিনেমায় অভিষেক হবেন বাবা, আর অমিতাভ ছেলে! আর বিদ্যা হবেন অমিতাভের মা!

এই আইডিয়ায় প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যান বিদ্যা। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “প্রথমে মনে হয়েছিল বালকি হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছেন। আমি অবাক হয়েছিলাম—একজন তরুণী অভিনেত্রী হয়ে কীভাবে আমি অমিতাভ বচ্চনের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করব!”

‘কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে’—সতর্ক করেছিলেন সবাই
বিদ্যা জানান, অনেকেই তখন তাঁকে সাবধান করেছিলেন। বলেছিলেন, “তুমি যদি বৃদ্ধ মায়ের চরিত্রে অভিনয় করো, তাহলে কেউ আর তোমাকে নায়িকার চরিত্রে কাস্ট করবে না। কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে।” কিন্তু বিদ্যা নিজে সেই স্ক্রিপ্ট নিজের বন্ধুদের—একজন লেখক ও একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা—পড়তে দেন। তাঁরাও এই চরিত্রটি করতে বিদ্যাকে উৎসাহিত করেন। শেষ পর্যন্ত হৃদয়ের কথা শুনে রাজি হয়ে যান অভিনেত্রী।

‘পা’—সিনেমা নয়, ইতিহাস
‘পা’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করেন অরো নামের এক শিশুর চরিত্রে, যে প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর দেহে বয়সের ছাপ দ্রুত পড়ে, ফলে শিশুর শরীরে বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা দেয়। সেই ছোট ছেলেটির মা ছিলেন বিদ্যা বালান, আর বাবা চরিত্রে ছিলেন অভিষেক বচ্চন।

এই অদ্ভুত কিন্তু মানবিক গল্পটি রীতিমতো দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। বিদ্যার অভিনয় বিশেষ প্রশংসিত হয়, যেখানে একজন সিঙ্গেল মাদার তার অসুস্থ সন্তানের জন্য সংগ্রাম করেন—তা নিছক নাটকীয়তাই নয়, এক আবেগঘন বাস্তবতায় ভরা।

জাতীয় পুরস্কারজয়ী ছবি
‘পা’ ছবিটি বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পায়। শুধু তাই নয়, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও প্রশংসিত হয়। ছবিটি সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্ম-এর জাতীয় পুরস্কার জেতে। অমিতাভ বচ্চন জিতে নেন সেরা অভিনেতা-র জাতীয় পুরস্কার। বিদ্যার অভিনয়ও ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায় সমালোচকদের কাছ থেকে।

১৫ বছর পর ফিরে দেখা
আজ সেই ছবির মুক্তির ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। আর বিদ্যাও বলিউডে নিজের ২০ বছরের সফল কেরিয়ার উদ্‌যাপন করছেন। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি কখনোই ভাবিনি, ওই চরিত্রটি আমার কেরিয়ারে এমন মোড় আনবে। অভিনয়ের তাগিদ থেকেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। আমি লোকের কথা শুনিনি, শুনেছিলাম নিজের মনের কথা।”

বিদ্যার বার্তা—নির্ভর করুন নিজের উপর
এই গল্প একটিই বার্তা দেয়—যদি নিজের প্রতিভা আর আত্মবিশ্বাসে ভরসা থাকে, তবে অন্যের কণ্ঠস্বর থামাতে হয় না, নিজের কাজই তাদের উত্তর হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যা বালান সেই দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, যেখানে ‘মা’ হওয়ার অর্থ কেরিয়ার শেষ নয়, বরং নতুন শুরু।

‘পা’ ছবির মাধ্যমে বিদ্যা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন—একটা চরিত্র বয়স দিয়ে নয়, অভিনেত্রীর অনুভব আর অভিনয় দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে।