ঢাকা শহরের তরুণদের জীবনের হাসি-কান্না, বন্ধুত্ব, প্রেম আর টিকে থাকার লড়াইকে ঘিরে তৈরি হওয়া গল্প ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ আজ শুধু টিভি সিরিজ নয়, বরং এক প্রজন্মের আবেগের নাম। বন্ধুত্বের টান, মফস্বল থেকে উঠে আসা তরুণদের স্বপ্ন, রঙিন শহর জীবনের বাস্তবতা সব মিলিয়ে এই সিরিজ হয়ে উঠেছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ফেনোমেনা। আট বছর ধরে টানা প্রচারিত এই ধারাবাহিক এখনো তরুণদের আলোচনায়, মিমে, সামাজিক মাধ্যমে ও ক্যাম্পাসের আড্ডায় সমান জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার কারণ প্রসঙ্গে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। কালবেলার পাঠকদের জন্য তাদের প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
ঢাকা শহরের একটি অ্যাপার্টমেন্টে বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন তরুণের বসবাস, যারা উঠে এসেছেন মফস্বল থেকে। তাদের জীবনের নানা ঘটনা এবং তাদের ঘিরে আশপাশের মানুষজনের প্রতিদিনের জীবন-যাপন—মোটাদাগে এটাই দীর্ঘ ধারাবাহিক ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর গল্প। এই সময়ের তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে সিরিজটি। চারটি মৌসুম শেষে এখন প্রচারিত হচ্ছে পঞ্চম মৌসুম। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে সিরিজটি চলছে দীর্ঘ আট বছর ধরে। এই নাটকের জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে গেছে যে, একেকটি নতুন সিজনের দাবিতে তরুণদের টিভি চ্যানেলের অফিসের সামনে মানববন্ধনের ঘটনাও ঘটেছে। সামাজিক মাধ্যমে হয়েছে প্রচুর লেখালেখি এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হয়েছে মিছিলও।
পরিচালক কাজল আরেফিন অমির মন্তব্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এমন এক সময়ে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ সিরিজের যাত্রা, যখন আসলে একটা সিরিয়াল না করলে পরিচালকদের সেভাবে নতুন কোনো কাজ পাওয়ার সুযোগ ছিল না এবং পরিচালক হিসেবে গণ্য করা হতো না। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ওই সময় ক্যারিয়ার নিয়ে এমন সংকটে পড়েছিলাম যে, হয় সিরিয়াল করতে হবে, না হয় এই পেশাই বদলাতে হবে। তিনি জানান, তার তখন মনে হতো, দেশের বাইরে বিশেষ করে থাইল্যান্ড-নেপাল গিয়ে তিনি কীভাবে নাটক নির্মাণ করবেন, কারণ তিনি বড় হয়েছেন ঢাকা শহরে এবং তিনি এই শহরের বা এই দেশের গল্প বলতে চান। তাই তিনি সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। তখন দেশের সিরিয়াল করা নিয়ে অমির আলাপ হয় প্রযোজক সৈয়দ ইরফান উল্লার সঙ্গে এবং তিনিই অমিকে বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাইনে একটা সিরিয়াল করার সুযোগ করে দেন। পরিচালক কাজল আরেফিন অমি বলেন, তিনি ঢাকায় বড় হয়েছেন, সেখানেই তার পুরো পরিবার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন ব্যাচেলর বন্ধুদের বাসায় যাওয়া-আসা ছিল এবং সেইসব বন্ধুদের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ শুরু করেন ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’।
শুরুতে ১০৪ পর্ব হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কিছু জটিলতায় ৫৩ পর্বে সিরিয়ালটি বন্ধ হয়ে যায়। অমি জানান, বন্ধ হওয়ার কারণটা তিনিও বুঝতে পারেননি। তবে ওই ৫৩ পর্বই অনেকে পছন্দ করেন। তখন অবশ্য ফেসবুক বা ইউটিউবে নাটকের এমন দাপট ছিল না, কিন্তু তারা জনপ্রিয়তা টের পেতে থাকেন। অমি জানান, ২০১৭ সালে নাটকটি শুরু হলেও ৫৩ পর্ব শেষ হয় ২০১৮ সালে। তখনও এই দেশে সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ ব্যাপারটি সেভাবে শুরু হয়নি। এমনকি পরিচালকসহ পুরো টিম ‘সিজন’ বিষয়টার সঙ্গেও অতটা পরিচিত ছিলেন না, তাই সেরকম কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু এর মধ্যে ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট আবার ফেরত চাই’ দাবিতে মানববন্ধনের খবর পান অমি। খবর পান মিছিলেরও। রীতিমতো ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মানববন্ধন। তারপর নড়েচড়ে বসেন পরিচালকসহ পুরো টিম। কিন্তু চ্যানেলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সেটা আর আগায় না। কিন্তু ভক্তরা থেমে থাকেননি। জানা যায়, ওই সময় পুরান ঢাকার একদল তরুণ ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নামে একটি গ্রুপ খোলেন ফেসবুকে। তারপর ব্যাচেলর পয়েন্ট ভক্তরা একত্রিত হন এবং একদিন চ্যানেল নাইন ঘেরাও করেন তারা। তাদেরও দাবি ছিল ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ আবার শুরু করা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চ্যানেল নাইনের ওই সময়ের অনুষ্ঠান প্রধান তানভীর খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৫২ বা ৫৩ পর্বের পর ওই সময় চ্যানেল নাইনে সিরিয়ালটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন সিরিয়ালটির ভক্তরা মিলে চ্যানেলের সামনে মানববন্ধন করেন। তবে পুরো ব্যাপারটি ইতিবাচক ছিল এবং তাদের দাবি ছিল আবার যেন সিরিয়ালটি চালু করা হয়। ব্যাচেলর পয়েন্ট জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, তার অভিজ্ঞতা বলে এবং ওই সময়ই তিনি বুঝতে পারছিলেন যে মানুষ শর্ট কনটেন্ট পছন্দ করছেন। একই সঙ্গে ‘র’ কনটেন্ট। অনেক সাজানো গোছানো-স্ক্রিপ্টেড কনটেন্টের চেয়ে ‘র’ কনটেন্ট বেশি দেখছে। তাছাড়া মধ্যবিত্ত তরুণদের কনটেন্টও মানুষ দেখছে। এর সবকিছুই ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এ আছে। তবে চ্যানেল নাইনে আলাপ এগোলেও পরের সিজনগুলো প্রচার হয় বাংলাভিশন এবং ধ্রুব টিভি নামের ইউটিউব চ্যানেলে। ধ্রুব টিভির স্বত্বাধিকারী ধ্রুব গুহ জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে বলেন, খেয়াল করে দেখবেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১৮ থেকে ৩৫ বছর তরুণ-তরুণী বেশি। তো যতক্ষণ তারা এটা দেখেন ততক্ষণ তারা সবকিছু ভুলে গিয়ে একটা মজা পায়, বিনোদন পায়।
‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ সিরিজে অভিনয় করে অনেক অভিনেতা তুমুল জনপ্রিয় হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে কাবিলা চরিত্রে অভিনয় করা জিয়াউল হক পলাশ এবং শিমুল চরিত্রে অভিনেতা শিমুল শর্মার বেলায়। দুজনই এসেছিলেন পরিচালক কাজল আরেফিন অমির সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতে। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময়ই এবং ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ শুরু করার আগে পলাশ দু-চারটা নাটকে ‘পাসিং শটে’ অভিনয় করেছেন। আর ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ সিরিজের শুরু থেকে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে। অমি বলেন, পলাশ এসেছিল সহকারী পরিচালক হতে। ওর ধ্যানজ্ঞান নির্মাণ নিয়ে। কিন্তু টুকটাক অভিনয় করতে দিলেও দারুণ করে। তখনই চিন্তা করি বড় কোনো সিরিয়াল করলে ওকে কেন্দ্রীয় চরিত্র দেব। এই কারণেই ওকে ওই চরিত্রে নেওয়া। শুধু পলাশ নয়, সহকারী পরিচালক হিসেবে অমির সঙ্গে কাজ করতে এসেছিলেন শিমুল শর্মাও। এখন তিনি পুরোদস্তুর অভিনেতা হয়েছেন এবং জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন বেশ। শিমুল সম্পর্কে অমি বলেন, ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ শুরু করার সময় তার সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে শিমুল। তখন অন্যান্য নাটকে একটা দুটা সিন করত। তৃতীয় সিজন থেকে ওকে পুরোদমে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে যুক্ত করেন।
‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ সিরিজটি নিয়ে কিছু সমালোচনাও শোনা যায়। অনেকে অভিযোগ করেন, এখানে কিছু অশ্লীল বক্তব্য বা আচরণ দেখা যায়। সেসব নিয়ে প্রযোজক ধ্রুব গুহ বলেন, আসলে নাম হলো ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’। মানুষ ব্যাচেলর থাকার সময় জীবন অতটা গোছানো থাকে না। সেগুলো নাটকেও চলে আসে অনেক সময়। সমালোচনা-আলোচনা সবকিছুই থাকে। তবে সমালোচনার জবাব দেন পরিচালক অমি। তিনি বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত একটা কনটেন্ট টেনে নিয়ে এসেছি। দর্শকরাও কুইক রেসপন্স করেন। তো এটার মধ্যে কিছু না কিছু তো আছে। অনেকে দাবি করেন, ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ অশ্লীল। কিন্তু সব সিজনের প্রতিটি পর্ব দেখুন, কোথাও কোনো এডাল্ট (প্রাপ্তবয়স্ক) শট পাবেন না। শুধু তাই না, কোনো ছেলেমেয়ের হাত ধরা দৃশ্য পাবেন না। তবে ডাবল মিনিং সংলাপ নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়। এমন আলোচনা ও অভিযোগের জন্য ২০২২ সালে সিজন ৪-এর বেশ কয়েকটি পর্ব ইউটিউব থেকে নামানোর কথা শোনা গেছে। এছাড়া অভিনয়শিল্পীদেরও ফেসবুকের মাধ্যমে ক্ষমা চাইতে হয়েছে।
পঞ্চম সিজনে এসে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ প্রথমবার প্রচার হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ বিডিতে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যয় করে দেখতে হচ্ছে নাটকটি। কেমন সাড়া পাচ্ছেন জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির টিফ কনটেন্ট অফিসার মুশফিকুর রহমান বলেন, তাদের যে প্রত্যাশা ছিল তার চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েকশো নাটক ও সিরিজ তৈরি হয়। কিন্তু কেন এই নাটকটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে? এর পেছনে আসলে কী কাজ করেছে? এই প্রসঙ্গে নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা তারিক আনাম খান বলেন, পরিচালক কাজল আরেফিন অমি দর্শকের পালসটা বুঝে সেভাবেই নির্মাণ করেছে। পাশাপাশি তিনি বলেন, কমার্শিয়ালি সাকসেসফুল করাও যোগ্যতার ব্যাপার। এটা নিয়ে অভিযোগও শোনা যায়, তবে খুব ভালগার কিছু থাকলে দর্শকই রিজেক্ট করত। আপামর দর্শক যেহেতু দেখছে তাই তার মনে হয় কনটেন্টের নিজস্ব একটা গুণ আছে। টানা আট বছরে পাঁচটি সিজন আসার সঙ্গে বেড়েছে বাজেটও। পরিচালক অমি জানান, প্রথম সিজনের জন্য বাজেট ছিল প্রতি পর্বের জন্য ৫৫ হাজার টাকা। সেই তুলনায় এখন প্রতি পর্বে বাজেট বেড়েছে ১২ থেকে ১৩ গুণ। অমি বলেন, শুধু নাটকের বাজেট বেড়েছে এমন নয়, অভিনয়শিল্পীদের রেমুনারেশনও বেড়েছে। তারা আগে বাইরে যে সম্মানিতে কাজ করেছেন এখন তারা বাইরে কয়েকগুণ বেশি সম্মানি পান। কত সিজন পাড়ি দেবে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, যতদিন ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ মানুষ চাইবে, ভালোবাসবে- ততদিন চলবে। তবে তিনি ঠিক জানেন না কোথায় ফুলস্টপটা দেবেন।