চলতি শতকের শুরুতে ‘বর্ন’ ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে হলিউডের অ্যাকশন সিনেমায় নতুন ভাষা এনেছিলেন পল গ্রিনগ্রাস। তাঁর সিনেমায় থাকে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, আর সেই সঙ্গে কাঁপতে থাকা ক্যামেরার ধাবমান ছন্দ। ছোট ছোট দৃশ্য আর নিরবচ্ছিন্ন গতির ভেতর দিয়ে তিনি তৈরি করেন বাস্তবের মতো রোমাঞ্চ। পরের দিকে নির্মিত ‘গ্রিন জোন’ ও ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’-এও সেই ধারা বজায় রেখেছেন তিনি। এবার তিনি এসেছেন দাবানলের ভয়াবহ বাস্তবতা নিয়ে, ‘দ্য লস্ট বাস’। ভয়, তাপ, বিশৃঙ্খলার মধ্যেও মানবতার আলো খোঁজার এই সিনেমাটি গ্রিনগ্রাসের নির্মাণ দক্ষতার এক অনন্য উদাহরণ।

২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ভয়াবহ ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘দ্য লস্ট বাস’। সেই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৮৫ জন, পুড়ে যায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার একর এলাকা। গ্রিনগ্রাস ও সহ-লেখক ব্র্যাড ইনগেলসবাই অনুপ্রেরণা নিয়েছেন সাংবাদিক লিজি জনসনের বই Paradise: One Town’s Struggle to Survive an American Wildfire থেকে। বইটি বলে এক স্কুলবাস চালক কেভিনের সাহসিকতার গল্প, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে শিশু ও শিক্ষিকাদের বাঁচিয়েছিলেন আগুনের কবল থেকে।

কেভিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ম্যাথু ম্যাকনাহে একজন ক্লান্ত, পরাজিত, তবু মানবিক মানুষ। শিক্ষিকা মেরি লুডউইগের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আমেরিকা ফেরেরা, যিনি যত্নশীল অথচ দৃঢ়চেতা। ধীরে ধীরে তাঁদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক মানবিক বন্ধনে, অনেকটা ‘দ্য আফ্রিকান কুইন’-এর মতোই। আগুন লাগার আগ পর্যন্ত কেভিনের জীবন ছিল বিশৃঙ্খল দেনায় জর্জরিত, ছেলের সঙ্গে দূরত্ব, চাকরি হারানোর আশঙ্কা। কিন্তু বিপর্যয়ের মুহূর্তেই তিনি হয়ে ওঠেন সত্যিকারের নায়ক। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ম্যাথু ম্যাকনাহের ছেলে লেভি বাস্তব জীবনের মতোই ছবিতেও তাঁর ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যা সিনেমার আবেগকে আরও গভীর করে তুলেছে।

গ্রিনগ্রাসের ক্যামেরা যেন আগুনেরই অংশ এক মুহূর্ত স্থির থাকে না। ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ তার থেকে শুরু হওয়া আগুন মুহূর্তেই গ্রাস করে শহর। শিশুদের সরিয়ে নিতে কেভিন চালু করেন স্কুলবাস। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রাস্তায়, জ্বলন্ত বাতাসে বাসের ভেতর দমবন্ধ অবস্থা। মেরি প্রায় হাল ছেড়ে দেন ‘এভাবে ঘুমিয়ে পড়াই ভালো নয় কি?’ কেভিন দৃঢ় গলায় বলেন, ‘না, এখনো নয়।’ সেই ভয়, তাপ আর বিশৃঙ্খলা গ্রিনগ্রাসের ক্যামেরায় এতটাই বাস্তব মনে হয়, যেন দর্শক নিজেরাই আগুনের মধ্যে আটকে আছে।

চিত্রগ্রাহক পল উলভিক রকসেথের সঙ্গে এটি গ্রিনগ্রাসের দ্বিতীয় কাজ। তাঁদের আগের সিনেমার মতোই এখানে ক্যামেরা কাঁপে, ঘোরে, দৌড়ায়। কারও কারও কাছে এই স্টাইল অস্বস্তিকর লাগতে পারে, কিন্তু ঠিক এই কাঁপুনিই সিনেমার বাস্তবতাকে আরও তীব্র করে তোলে। যদিও দর্শক শুরু থেকেই জানেন, সবাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাবে, তবু সিনেমার উত্তেজনা এক মুহূর্তের জন্যও থামে না। আগুনে জ্বলতে থাকা গাছ, ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ, আর পুড়ে যাওয়া গাড়ির সারি মিলিয়ে তৈরি হয় ভয়ঙ্কর অথচ মুগ্ধকর এক দৃশ্যপট।

এই ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কেভিন ও মেরির সংগ্রাম। ২২ শিশুকে নিয়ে আগুনের ভেতর বাঁচার লড়াইয়ে তাঁদের সাহস, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার প্রকাশ ঘটে প্রতিটি মুহূর্তে। শিশুদের আতঙ্ক নয়, বরং প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক লড়াইকেই পরিচালক প্রাধান্য দিয়েছেন। মেরি একদিকে শিশুদের সান্ত্বনা দেন, অন্যদিকে নিজের ভয় লুকিয়ে রাখেন। তিনি বলেন, ‘হয়তো আর ছেলেকে দেখব না।’ কিন্তু তবু হাল ছাড়েন না।

শেষে পর্দায় উঠে আসে বাস্তব তথ্য, বৈদ্যুতিক সংস্থাকে আদালত দায়ী করেছে এই আগুনের জন্য। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যার নাম সিনেমায় উচ্চারিত হয় না, তিনি দোষ দেন বনবিভাগকে। কেউ ‘জলবায়ু সংকট’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেন না, এই অনুচ্চারিত সত্যই সিনেমার একমাত্র দুর্বলতা। কারণ, ‘দ্য লস্ট বাস’ আগুনের ভেতর মানুষের লড়াই দেখালেও পরিবেশ সংকটের গভীরে পুরোপুরি পৌঁছায় না।

দুই ঘণ্টা নয় মিনিটের এই সিনেমার বেশির ভাগ সময়ই কাটে বাসের ভেতরে। বাইরের আতঙ্ক, অপেক্ষমাণ মা-বাবার দৃশ্যগুলোতেও বাড়াবাড়ি আবেগ নেই। বরং সংযম, বাস্তবতা আর মানবিকতার টানই ছবির মূল শক্তি। ফায়ার বিভাগের প্রধান যখন বলেন, “এখন আর সম্পদ বাঁচানোর কিছু নেই, এখন শুধু মানুষ বাঁচাতে হবে” তখনই ফুটে ওঠে সিনেমার আসল বার্তা।

পল গ্রিনগ্রাসের চলচ্চিত্র জীবনের শুরু ছিল তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে। সেই বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গিই তিনি ধরে রেখেছেন ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’, ‘ইউনাইটেড ৯৩’, কিংবা ‘ব্লাডি সানডে’-এর মতো সিনেমায়। তাঁর মতে, “বাস্তবতা ও নাটকীয়তার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পাওয়াই আমার লক্ষ্য।”

‘দ্য লস্ট বাস’-এ আগুন শুধু বিপর্যয় নয়, এটি যেন একটি জীবন্ত চরিত্র ‘জস’-এর হাঙরের মতো। আগুনের শব্দ, তাপ, আর ভয় সিনেমার প্রতিটি মুহূর্তে ছড়িয়ে আছে। বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায় আবেগ, আর সেই মিশ্রণেই তৈরি হয় এক গভীর মানবিক গল্প যেখানে প্রমাণিত হয়, নায়কত্ব জন্ম নেয় না খ্যাতি থেকে, জন্ম নেয় সংকটের মুখে সাধারণ মানুষের সাহস থেকে।

‘দ্য লস্ট বাস’ এখন দেখা যাচ্ছে অ্যাপল টিভি প্লাসে