২০২৩ সালের ২৮ জানুয়ারি মিরপুরের একটি শুটিং হাউসে আচমকা বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই আগুনে দগ্ধ হন অভিনেত্রী শারমিন আঁখি। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীরের প্রায় ৩৫ শতাংশ দগ্ধ হয় চুল, হাত-পা, শরীরের বিভিন্ন অংশে আগুনের দাগ রয়ে যায়। এক বছরেরও বেশি চিকিৎসার পর আবারো ফিরে এসেছেন তিনি অভিনয়ে। আগুনের ভেতর দিয়েই যেন জন্ম হলো নতুন এক আঁখি। টেলিভিশন, মঞ্চ, সিনেমা সবখানেই পরিচিত মুখ তিনি, আর এবার খুঁজে পেয়েছেন কণ্ঠ অভিনয়ের নতুন ভুবন।
আগুনের স্মৃতি আজও আঁখির মনে বাসা বেঁধে আছে। তিনি বলেন, “হাতজুড়ে ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। মেকআপে ঢাকলেও পুরোপুরি যায় না। কখনো সখনো অভিনয়ের সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” হাসপাতালের দীর্ঘ ৬০ দিন যেন ছিল তাঁর কাছে এক যুদ্ধক্ষেত্র। সেই লড়াই তাঁকে জীবনকে নতুনভাবে বোঝার, নিজেকে ভালোবাসার এবং পৃথিবীকে অন্য চোখে দেখার শিক্ষা দিয়েছে।
দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার মধ্যেও মানসিক যন্ত্রণা সহজ ছিল না। অভিনয়ে ফেরার পথও সহজ হয়নি। প্রযোজকদের কাছে পৌঁছেছেন, ফোন করেছেন, কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পাননি। তবু হাল ছাড়েননি। আঁখি বলেন, “একজন শিল্পী একা কিছু করতে পারে না। সহযোগিতা দরকার। সেটা খুব একটা পাইনি। তবে বুঝেছি, বসে থাকলে চলবে না।”
তিনি জানেন, দগ্ধ হওয়া শুধু শরীরের ক্ষত নয় এটা মানসিক শক্তিরও পরীক্ষা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অন্য রোগীদের পরামর্শ দেন, সংক্রমণ এড়িয়ে চলা, ধৈর্য ধরে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নেওয়া এবং মানসিক শক্তি ধরে রাখা মূল চাবিকাঠি।
অভিনয়ে ফেরার পথ সহজ না হলেও একদিন নতুন সুযোগ পেলেন কণ্ঠ অভিনয়। পরিচিতজনের প্রস্তাবে ডাবিং স্টুডিওতে যাত্রা শুরু হয়। ‘হারকিউলিস’, ‘ম্যাকগাইভার’, ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’, ‘কুরুলুস ওসমান’, ‘বড় ভাই’ এসব জনপ্রিয় সিরিজে কণ্ঠ দিয়ে চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন। এখন মাসজুড়ে ডাবিংয়ের ব্যস্ততায় কাটে তাঁর সময়। আঁখি বলেন, “ডাবিং আমাকে মানসিক শান্তি দিয়েছে এবং আবার কাজে ফিরতে সাহায্য করেছে।”
তবে শুধু কণ্ঠ নয়, অভিনয়েও ফেরার চেষ্টা করছেন তিনি। রাহাত কবিরের ফিকশন ‘ফাইভ গো ওয়াইল্ড’ এ কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। দুর্ঘটনার পর এটি তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প। এতে একটি আইটেম গানে নাচতেও দেখা গেছে তাঁকে। আঁখি বলেন, “শুরুর দিকে ভয় ছিল, আত্মবিশ্বাস কম ছিল। পরে বুঝলাম, চেষ্টা করলে সব সম্ভব।”
চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা আঁখির অভিনয়ের হাতেখড়ি মঞ্চে। অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে অভিনয় করে প্রথম প্রশংসা পান। এরপর নাটক, বিজ্ঞাপন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং সিনেমায় নিয়মিত হয়েছেন। ২০১০ সালে নার্গিস আক্তারের নাটক ‘ভালোবাসা কি করে ভালো হয়’ দিয়ে আলোচনায় আসেন। পরে ইতি, তোমারই ঢাকা, কোনো এক কালে, জাস্ট এ জোক ডার্লিংসহ একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন। শঙ্খ দাশগুপ্তর সিরিজ বলিতে অভিনয় করে আবারো আলোচনায় আসেন।
দগ্ধ হওয়ার পরও হার মানেননি শারমিন আঁখি। এখন তিনি কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেত্রী দুই পরিচয়েই এগিয়ে চলেছেন। তাঁর ভাষ্যে, “আত্মবিশ্বাস এসেছে, চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। আমার যাত্রা এখানেই শেষ নয়।” তাঁর গল্প শুধু একজন অভিনেত্রীর প্রত্যাবর্তন নয়, এটি আগুন পেরিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠা এক নারীর সাহসী পুনর্জন্মের কাহিনি।