বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, বেশিরভাগ সিনেমাই ছিল যুদ্ধ, সামাজিক সমস্যা বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। 'ওরা ১১ জন' বা 'রক্তাক্ত বাংলা'র মতো সিনেমাগুলো সেই সময়ের কথা বলেছিল। ঠিক তখনই, ১৯৭৩ সালের কোরবানির ঈদে মুক্তি পেলো জহিরুল হকের 'রংবাজ'।
এই সিনেমাটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। এটি বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন সিনেমা। এখানে কোনো যুদ্ধের ট্র্যাজেডি ছিল না, বরং ছিল একজন অ্যান্টি-হিরোর গল্প। রাজ্জাককে দেখা গিয়েছিল একজন স্টাইলিশ পকেটমার ও মাস্তান ‘রাজা’র চরিত্রে, যার সঙ্গে ছিল কবীরীর অনবদ্য রোম্যান্স। তার মারপিট, সংলাপ, পোশাক সবকিছুই ছিল তখনকার দর্শকদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা।
'রংবাজ' শুধু হিটই হয়নি, এটি বাংলা সিনেমায় নতুন একটি ধারা তৈরি করে। এই ছবির সাফল্যের পর 'দোস্ত দুশমন' বা 'মিন্টু আমার নাম'-এর মতো আরও অনেক অ্যাকশন সিনেমা তৈরি হয়। এই ছবিতে মারপিটের দৃশ্য পরিচালনা করে জসিম প্রথমবার লাইমলাইটে আসেন। সিনেমার গানগুলো, যেমন 'হই হই হই রঙিলা রঙিলা রে' এবং 'সে যে কেন এল না', আজও মানুষের মুখে ফেরে।
আরেকটি মজার তথ্য হলো, বলিউডে যখন অমিতাভ বচ্চনের 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান' ইমেজ তৈরি হচ্ছিল 'জঞ্জির' (১৯৭৩) সিনেমার মাধ্যমে, তার চার মাস আগেই 'রংবাজ'-এর 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান' রাজা চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল। ছবিটি মাত্র ৬০ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি হলেও ৩ কোটি টাকার ব্যবসা করে।
'উৎসব'-এর ম্যাজিক (২০২৫)
এখন থেকে ৫২ বছর পর, ২০২৫ সালের কোরবানির ঈদে মুক্তি পেলো তানিম নূরের 'উৎসব'। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা সিনেমার জগতটা ছিল ক্রাইম, থ্রিলার আর অ্যাকশনে ভরপুর। 'তুফান', 'বরবাদ', 'তান্ডব'-এর মতো ছবিগুলো দর্শকদের পছন্দের তালিকায় ছিল।
এই অ্যাকশন আর সহিংসতা থেকে দূরে গিয়ে 'উৎসব' দর্শকদের দেখালো একটি পারিবারিক গল্প। সিনেমার ট্যাগলাইনই ছিল, 'পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ'। ছবিটি যেন পাশের বাড়ির গল্প, যা দর্শকদের নব্বই দশকের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এখানে দর্শক জাহাঙ্গীর নামের এক মানুষের ভুল, আফসোস আর অনুশোচনাকে দেখতে পায়। জাহাঙ্গীরের চরিত্রটি তাকে নিজের ভুলের থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালো মানুষ হতে শেখায়।
জাহিদ হাসান, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, সৌম্য জ্যোতি ও সাদিয়া আয়মান-এর মতো শক্তিশালী অভিনেতাদের নিয়ে তৈরি এই ছবিটি প্রমাণ করে যে দেশি গল্প, যেখানে দক্ষিণী ছবির কোনো প্রভাব নেই, সেটিও দর্শকদের হলে টানতে পারে।
দুটি ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভাবনা
১৯৭৩ সালে 'রংবাজ' যখন মুক্তি পায়, তখন অনেকেই এটিকে 'সর্বনাশের ধারার সূচনা' বলে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একইভাবে, 'উৎসব'-কে অনেকে 'নাটক' বলে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কে জানে, হয়তো এই ছবিটিই ভবিষ্যতে আরও অনেক ভালো পারিবারিক গল্পের সিনেমা তৈরির অনুপ্রেরণা হবে।
'রংবাজ' যেমন ৫০ বছর ধরে আলোচনার বিষয়, 'উৎসব'-এর ক্ষেত্রেও তেমনটা হতে পারে। দুটি ছবিই প্রমাণ করে যে ব্যতিক্রমী ভাবনা থাকলে দর্শক তাকে সাদরে গ্রহণ করে।