মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়', 'নিঝুম রাতের আঁধারে' এবং 'ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী'—এই গানগুলো ব্যান্ড সংগীতপ্রেমীদের কাছে চিরন্তন। বিশেষ করে আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের শ্রোতাদের কাছে অবসকিউর ব্যান্ডের এসব গান আজও সমান জনপ্রিয়। প্রথম অ্যালবাম দিয়েই শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিল ব্যান্ডটি। সেই কালজয়ী অ্যালবাম ও তার পেছনের গল্প নিয়েই আজকের এই লেখা।

১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ খুলনায় সাইদ হাসান টিপুর নেতৃত্বে গঠিত হয় ব্যান্ড অবসকিউর। এরপর তারা তাদের প্রথম অ্যালবামের কাজ শুরু করে সারগাম স্টুডিওতে। ১৯৮৬ সালে 'অবসকিউর ভলিউম ১' শিরোনামে অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়। ব্যান্ডে তখন টিপু (ভোকাল), মাসুদ (বেজ গিটার), জন (লিড গিটার), তুষার (রিদম গিটার), আজম বাবু (ড্রামস) এবং সোহেল (কিবোর্ড) ছিলেন।

অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'মাঝরাতে চাঁদ যদি'র জন্মও ছিল নাটকীয়। টিপু জানান, একদিন তাদের গান লেখার কাজ চলছিল। এমন সময় টিপুর বড় বোনের বান্ধবীর ভাই এহসান পকেটে করে একটি কাগজ তাকে দেন। তাতে লেখা ছিল, "মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায় / ভেবে নেব আজ তুমি চাঁদ দেখোনি..."। এই দুটি লাইন পড়েই টিপু মুগ্ধ হয়ে যান এবং এক বসায় পুরো গানের সুর তৈরি করে ফেলেন, যা পরবর্তীতে চূড়ান্ত রেকর্ডিংয়েও কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

এই অ্যালবাম তৈরির জন্য টিপু তার বাবার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন। তবে ব্যান্ড সদস্যদের ঢাকায় আসার পথে নানা ধরনের বাধা এসেছিল। কিবোর্ডিস্ট সোহেলের বাবা তার ছেলেকে গান-বাজনার জন্য ঢাকায় পাঠাতে রাজি ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে টিপু নিজে সোহেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন এবং অনেক কষ্টে তার বাবাকে রাজি করান।

ঢাকায় এসে তারা অনেক গুণী শিল্পীর সহযোগিতা পান, যাদের মধ্যে ফুয়াদ নাসের বাবু, মাকসুদ, লাবু, পিয়ারু, শেখ ইশতিয়াক এবং মাকসুদ জামিল মিন্টুর মতো শিল্পীরা ছিলেন। যেহেতু তাদের কোনো রেকর্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই অনেক কিছু শিখতে হয়েছিল। বাবু ও মিন্টু তাদের কিবোর্ডিস্টকে সহায়তা করেন। টিপু জানান, সেই সময়ের গানের মানুষেরা যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা ছিল অবিশ্বাস্য।

রেকর্ডিংয়ের সময়ও নানা মজার ও কঠিন ঘটনা ঘটে। পিয়ারু ভাই কিছু নতুন বাদ্যযন্ত্র এনেছিলেন, যেমন চাইম বেল, যা তারা প্রথমবার ব্যবহার করেন। জন নামের লিড গিটারিস্টের ভুল হওয়ার কারণে সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে বাজাতে অস্বীকার করে, কিন্তু টিপু তাকে জোর দেন। এমনকি রেকর্ডিংয়ের শেষ রাতে টিপু প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডায়রিয়া নিয়েও তিনি বাথরুমে যাওয়া-আসার মধ্যেই এক রাতে ১২টি গানের কণ্ঠধারণ শেষ করেন।

পরের দিন ভোরবেলা গানগুলোর হারমনি দিতে গিয়ে টিপু অবাক হয়ে দেখেন, তাদের স্বপ্নের শিল্পী তপন চৌধুরীলাকী আখন্দ স্টুডিওতে এসেছেন। তাদের সামনে গান গাইতে প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও, এই গুণী শিল্পীরা তাকে সাহস দেন। অবশেষে সেই ১২ হাজার টাকায় তৈরি হয় অবসকিউরের প্রথম অ্যালবাম, যা আজো শ্রোতাদের কাছে অমূল্য।