বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সালমান শাহ ছিলেন এক অনন্য ও ক্ষণজন্মা নক্ষত্র। মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে তিনি অর্জন করেছিলেন এমন জনপ্রিয়তা, যা আজও দর্শকের হৃদয়ে অমলিন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঘিরে প্রায় তিন দশক ধরে চলছে বিতর্ক এটা কি আত্মহত্যা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা?
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমান শাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর একে একে তদন্ত চালায় থানা পুলিশ, সিআইডি, র্যাব ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সব প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলা হলেও সালমানের পরিবার কখনোই তা মেনে নেয়নি। প্রতিবারই তদন্ত সংস্থা পরিবর্তনের আবেদন জানানো হয়, কিন্তু রহস্যের জট খুলে না।
পিবিআইয়ের সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিলেন, “খুন নয়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন।” কিন্তু সালমানের মা নীলা চৌধুরী বরাবরই দাবি করে আসছেন, তাঁর ছেলে হত্যা হয়েছেন, আত্মহত্যা নয়। তাঁর কথায়, “আমার ছেলে কখনোই আত্মহত্যা করতে পারে না।”
অন্যদিকে, সালমান শাহর সাবেক স্ত্রী সামিরা হক ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইমন (সালমান শাহ) মানসিকভাবে ‘সুইসাইডাল বাই নেচার’। বিয়ের আগেই সে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।” সামিরার দাবি, এসব ঘটনার রেকর্ড মেট্রোপলিটন হাসপাতালসহ একাধিক স্থানে রয়েছে। তিনি আরও জানান, একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, একবার তাঁকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য এবং আরেকবার অন্য এক কারণে সালমান আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
সামিরার মতে, সালমান মূলত সিনেমায় ক্যারিয়ার গড়তে চাননি; তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারিবারিক জটিলতা, বিশেষ করে মা নীলা চৌধুরীর সঙ্গে দূরত্ব, তাঁর মানসিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বলেন, “ইমন তার মাকে মা বা আম্মা বলে ডাকত না, বলত ‘মহিলা’। এই মানসিক দূরত্ব ও শৈশবের কিছু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল।” সেই সময় মানসিক কাউন্সেলিং বা রিহ্যাবের সুযোগ না থাকায় ইমন নিজের কষ্ট কারও সঙ্গে ভাগ করতে পারেননি।
তবে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, এটা কোনো আত্মহত্যা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যা। তিনি বিশ্বাস করেন, পিবিআই সঠিকভাবে তদন্ত করেনি এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ গোপন করেছে।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা সালমান শাহ অভিনয় করেছিলেন ২৭টি চলচ্চিত্রে, যার প্রায় সবই ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেমযুদ্ধ’সহ তাঁর প্রতিটি সিনেমা নব্বইয়ের দশকে রোমান্টিক নায়কের নতুন ধারা তৈরি করেছিল।
প্রায় তিন দশক পর আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে সালমান শাহর মৃত্যুর মামলা। সম্প্রতি ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রমনা থানাকে। সালমানের মা নীলা চৌধুরীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ জানান, “পিবিআইয়ের তদন্ত ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। আমরা সেই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেছিলাম। আদালত সেটি গ্রহণ করে পুনরায় হত্যা মামলা করার আদেশ দিয়েছেন।”
প্রায় ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সালমান শাহর মৃত্যুর রহস্য আজও অমীমাংসিত। নতুন মামলার নির্দেশের পর আবারও প্রশ্ন জেগেছে সালমান শাহ সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন, নাকি তিনি ছিলেন এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার?