ঘেটুপুত্র কমলার শিশুশিল্পী মামুন: আলো থেকে আড়ালে

হুমায়ূন আহমেদের শেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলা দিয়ে পরিচিতি পান অভিনেতা হাসান ফেরদৌস মামুন। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কমলা’ তাঁকে এনে দেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অভিনয় জীবনের জন্য এটি ছিল এক অসাধারণ অর্জন। কিন্তু ধীরে ধীরে বিনোদন অঙ্গন থেকে দূরে সরে যান তিনি। দীর্ঘ সাত বছর ধরে অভিনয়ে নেই মামুন; এখন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ভগ্নিপতির সঙ্গে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসায় ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জগত থেকে সরে এসে রড-সিমেন্টের হিসাব কষাই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।

অভিনয়ের হাতেখড়ি টোকাই নাট্যদলে

মাত্র চার বছর বয়সে মামুনের অভিনয়ে হাতেখড়ি। বড় বোনের হাত ধরে যাওয়া শুরু টোকাই নাট্যদলে। সেখানেই প্রথম মঞ্চে ওঠা এবং দলের হয়ে কয়েকটি প্রযোজনায় অভিনয়। ছোট পর্দায় তাঁর প্রথম কাজ বাংলাদেশ টেলিভিশনের হারমোনিয়াম নাটক। পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু বিটিভি নাটকে সুযোগ পান। এর পাশাপাশি বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় শুরু করেন তিনি।

‘কি বাবা, বলছিলাম...’

মামুনের প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলালিংকের ‘দিন বদলের পালা’। বিজ্ঞাপনটিতে তাঁর সংলাপ, “কি বাবা, বলছিলাম না আজকে অনেক মাছ উঠব, আমারে কিন্তু মেলায় নিয়া যাইতে হবে”  এখনো দর্শকদের মনে রয়ে গেছে। সেই বিজ্ঞাপনের জন্য তিনি মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে মনোনয়নও পান। এরপর ‘বেবি জিঙ্ক’ ও ‘প্রাণ জুস’-এর বিজ্ঞাপনে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা আরও বাড়ে। বিশেষ করে ‘তাইলে দশ টাকা দেন, ম্যাঙ্গো জুস খামু’ সংলাপটি তাঁকে আলাদা পরিচিতি এনে দেয়।

চলচ্চিত্রে যাত্রা

নাটক ও বিজ্ঞাপনের ব্যস্ততা থেকে ধীরে ধীরে সিনেমায় ডাক আসতে থাকে। প্রথম চলচ্চিত্র ছিল শফিকুল ইসলামের ওপারে আকাশ। এরপর মুরাদ পারভেজের চন্দ্রগ্রহণ এবং আবু সুফিয়ানের বন্ধু মায়া লাগাইছেভাড়াটে প্রেমিক ছবিতে অভিনয় করেন। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বাঁক আসে হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা-তে।

‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ও হুমায়ূনের স্নেহ

অডিশনে শতাধিক শিশুশিল্পীর মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন মামুন। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য মুহূর্ত। তিনি বলেন, “ভাবতেই পারিনি আমি নির্বাচিত হব। হুমায়ূন স্যার আমাকে নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। খাওয়ার সময়ও তিনি খেয়াল রাখতেন, আমি খেয়েছি কি না। আমি না খেলে উনি খেতেন না। এত স্নেহ তিনি করেছেন, যা কোনোদিন ভোলা যাবে না।”

২০১২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় ঘেটুপুত্র কমলা, যা হুমায়ূন আহমেদের অষ্টম ও শেষ চলচ্চিত্র। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আটটি বিভাগে সম্মান পায়। শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে পুরস্কার জেতেন মামুন। তবে এই দিনটিই তাঁর জন্য হয়ে ওঠে বেদনাময়। তিনি বলেন, “মেরিল প্রথম আলোতে যখন বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনের জন্য মনোনয়ন পাই, তখন মাকে নিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুরস্কার পাইনি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যখন পেলাম, তখন মা আর স্যার দুজনেই নেই। তাই পুরস্কারটা আমার কাছে হারিয়ে অর্জিত পুরস্কার।”

শতাধিক নাটক ও বিজ্ঞাপনে

ক্যারিয়ারে মামুন শতাধিক নাটক ও বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছেন। তবে ২০১৮ সালে রুবেল আনুশের প্রেমকাহন সিনেমায় শেষবারের মতো তাঁকে পর্দায় দেখা গেছে। এরপর থেকে অভিনয়ে অনুপস্থিত। তিনি জানান, জুতসই চরিত্র না পাওয়ায় নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। “এখনকার ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা আগের মতো নেই। তাই কাজ কম করেছি। তবে ভালো চরিত্র পেলে অবশ্যই ফিরব।”

অভিনয় থেকে ব্যবসায়

২৮ বছর বয়সী মামুন এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবনে অভ্যস্ত। তিন বছর আগে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীও শৈশবে থিয়েটার করতেন। এখন তাঁরা মোহাম্মদপুরে সংসার করছেন। সেখানেই নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা চালাচ্ছেন ভগ্নিপতির সঙ্গে। ব্যবসার ব্যস্ততার মাঝেও মাঝে মাঝে ইউটিউবে নিজের পুরোনো নাটক-সিনেমা দেখেন এবং স্মৃতিচারণ করেন। মামুন বলেন, “এত গুণী মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি, তা এখনো অবিশ্বাস্য মনে হয়। কোনো আক্ষেপ নেই, নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।”

হারিয়ে যাওয়া শিশুশিল্পী

বাংলাদেশের নাটক ও সিনেমায় শিশুশিল্পীরা একসময় জনপ্রিয়তা পেলেও অনেকেই সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যান। কেউ পড়াশোনায় মন দেন, কেউ ভিন্ন পেশায় চলে যান। মামুনও তাঁদেরই একজন। তবে তাঁর গল্প অন্যদের চেয়ে ভিন্ন, তিনি শিশুশিল্পী হয়েও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন। তবু সময় ও পরিস্থিতি তাঁকে আড়ালে ঠেলে দিয়েছে। মামুন বলেন, “আগে নাটক-সিনেমায় শিশু চরিত্রের জন্য আলাদা জায়গা ছিল। এখন সে সুযোগ কম। তাই কাজ না থাকলে সরে আসতে হয়।”

এখন তাঁর দিন কাটে ব্যবসায়, তবে রাতের নির্জনতায় মনে পড়ে সেই সময়, যখন ক্যামেরা চালু হতো আর পরিচালক বলতেন- “অ্যাকশন!”